‘জিকির’ একটি আরবি শব্দ। শাব্দিকভাবে স্মরণ করা, ধ্যান করা, তাসবিহ পাঠ করাসহ বহু অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাঁর সত্তাগত ও গুণগত নামের স্মরণ করাকে জিকির বলা হয়।

জিকির মহত্বপূর্ণ ইবাদাত। আল্লাহ তায়ালার জিকিরের মাধ্যমে আত্মিক পবিত্রতা অর্জিত হয়। হৃদয় প্রশান্ত হয়। ইবাদতে মনোনিবেশ করতে হৃদয়ে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। মন্দ কাজের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। মহান রবের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা জন্মায়। সেদিকে ইঙ্গিত করে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা যখন মহান আল্লাহর জিকির করে তাদের হৃদয়সমূহ নরম হয়ে যায়। যখন তার আয়াতমালা পাঠ করা হয় তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। আর তারা তো তাদের রবের প্রতি আস্থা রেখে থাকে।’(সূরা আনফাল : ০২) অন্যত্র এসেছে, ‘আর যারা ঈমান এনেছে, তাদের হৃদয় তো মহান আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে প্রশান্ত হয়।’ (সূরা র’দ : ২৮)

জিকির আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার নিদর্শন : আল্লাহ যাকে বেশি ভালোবাসেন তাকে এই সৌভাগ্য দান করেন। আর আল্লাহ তায়ালার অসন্তুষ্টির লক্ষণ হচ্ছে জিকিরের সৌভাগ্য নসিব না হওয়া। হজরত আনাস রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘মহান আল্লাহর ভালোবাসার নিদর্শন হলো আল্লাহর জিকিরকে ভালোবাসা। আর আল্লাহর অপছন্দের নিদর্শন হচ্ছে, আল্লাহর জিকির অপছন্দ করা।’ (বায়হাকি, হাদিস : ৪১০)

পুনরুত্থান দিবসে অত্যন্ত ভয়াবহ পরিস্থিতি ঘটবে। সবাই উান্তের মতো ছুটবে। বিভীষিকাময় অবস্থা থেকে কেউ রেহাই পাবে না। তবে সাত শ্রেণীর মানুষকে মহান আল্লাহ নিজ আরশের ছায়াতলে আশ্রয় দেবেন। তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হলো আল্লাহর জিকিরকারী। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘সাত ব্যক্তি এমন রয়েছে, যাদেরকে আল্লাহ আপন আশ্রয়ে স্থান দিবেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ওই ব্যক্তি যে আল্লাহর জিকির করে এরপর তার উভয় চোখ বিগলিত হয়ে যায়।’ (বুখারি, হাদিস-৬৪৭৯)

জিকিরকারীকে দেখলে আল্লাহর স্মরণ : যাদের হৃদয়ে রয়েছে আল্লাহর প্রতি মুহাব্বত, তারা অনবরত মহান আল্লাহর জিকিরে মত্ত হয়ে থাকেন। তাদের মাঝে গায়েবি নূর ফুটে ওঠে। তাদের দেখলেই মন নরম হয়ে যায়। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা তৈরি হয় ও আল্লাহর কুদরতের স্মরণ জাগ্রত হয়। হাদিসে এসেছে, ‘আল্লাহর নৈকট্যশীল বান্দা তারাই যাদের দেখলে আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত হয়।’ (সিলসিলাতুস সহিহাহ, হাদিস : ১৭৩৩)

সব কাজ হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য : ক্ষণিকের এই পৃথিবী কারো জন্য চিরস্থায়ী নয়। ধারাবাহিকভাবে ভাবলে; শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য তারপর জীবনের ইতি ঘটে। কিন্তু সবাই তো বার্ধক্যে পৌঁছতে পারে না। পরকালের তুলনায় এ সংসারের সময়কাল অত্যন্ত ক্ষীণ। খুবই নগণ্য সময়ের এই জগত থেকে সবাইকে বিদায় নিতে হবে। মহান আল্লাহর সম্মুখে উপস্থিত হতে হবে। সম্বল হিসেবে থাকবে শুধু আমল। এই পৃথিবীর সব কিছু অন্তঃসারশূন্য যদি সেটা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য না হয়। সেদিকে নির্দেশ করে হাদিসে বর্ণিত রয়েছে ‘মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনমূলক বিষয় ছাড়া পৃথিবী ও পৃথিবীতে থাকা সব কিছু অভিশপ্ত। (আল মারাসিল : -ইমাম আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৭)

মুমিনের সব কাজ ইবাদাত : একজন মুমিনের জীবন একটি গণিমত বা ধন-ভাণ্ডারের মতো : শুধু তাই নয়, ঈমানদারের সব কথা ও কাজকে ইবাদতের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তবে শর্ত হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। আর সব ধরনের ইবাদাত, চাই সেটা নফল বা ফরজ হোক। মহান আল্লাহ এর পূর্ণ প্রতিদান দিবেন। সেদিকে ইঙ্গিত করে হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, ‘মানুষ হচ্ছে স্বর্ণ রৌপ্যের ন্যায় খনিজসম্পদ সমতুল্য।’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস : ২৬৩৮)

প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে তার সব কাজের মূল লক্ষ্য হিসেবে মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনকে স্থির করে নেবে। ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমানো পর্যন্ত প্রতিটি কাজ আল্লাহর নামে শুরু করবে এবং তাঁর নামেই শেষ করবে। জিকির ছাড়া হৃদয় কঠিন হয়ে যায় : অনর্থক কথাবার্তা বা কাজ জীবনের জন্য কল্যাণকর কিছু বয়ে আনে না। বরং এর মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয় এবং হৃদয় শক্ত হয়ে যায়। ফলে পবিত্র ইসলামের বাণী অন্তরে সহজে প্রবেশ করতে পারে না। তাই শক্ত হৃদয় সিক্ত হয় না। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: থেকে বর্ণিত, ‘তোমরা আল্লাহর জিকির ছাড়া অন্য বিষয়ে বেশি কথা বলবে না। কেননা, আল্লাহর জিকির ব্যতিরেকে অধিক কথা হৃদয়কে কঠোর করে তোলে। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ থেকে অধিক দূরবর্তী সেই যার হৃদয় কঠিন।’ (তিরমিজি হাদিস-২৪১১)

জিকির স্বল্পসময়ে বেশি সওয়াবের আমল : জিকিরের আমলের ওপর অবিচল থাকা এবং ধারাবাহিকভাবে আমল করা সহজ। নিয়মিত জিকির করলে অন্যান্য আমল করাও সহজ হয়ে যায়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে বুসর রা: থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সা: ইসলামের বিধি-বিধান আমার কাছে অনেক বেশি মনে হচ্ছে। আমাকে এমন কিছু বলে দিন যেন আমি সেটার ওপর অবিচল থাকতে পারি। তখন রাসূল সা: বললেন, আল্লাহর স্মরণে তোমার জিহ্বা সবসময় যেন সতেজ থাকে।’ (তিরমিজি হাদিস-৩৩৭৫)

উত্তম জিকিরের কিছু বাক্য : ইবাদতের বিভিন্ন শাখায় যেমনি শ্রেষ্ঠত্বের তারতম্য রয়েছে তদ্রুপ জিকিরের মাঝেও রয়েছে শ্রেষ্ঠ কিছু বাক্য। এসব কালিমা বা বাক্যের মাধ্যমে মহান আল্লাহর জিকির করলে তিনি বেশি সন্তুষ্ট হোন। যেমন হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত, ‘সর্বোত্তম জিকির হচ্ছে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আর সর্বোত্তম দোয়া হচ্ছে, আলহামদুলিল্লাহ।’ (তিরমিজি, হাদিস-৩৩৮৩) অন্যত্র এসেছে, সর্বোত্তম কথা ‘সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং আল্লাহু আকবার।’ (সহিহুল জামে : হাদিস-১১২৭)

হজরত আবু যর গিফারি রা: থেকে বর্ণিত, ‘আল্লাহ তায়ালা বান্দার জন্য সর্বোত্তম কালাম সাব্যস্ত করেছেন, ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি।’ (সিলসিলাতুস সহিহা-হাদিস-১৪৯৮)

মহান আল্লাহর স্মরণ মানুষকে যেমন করে কল্যাণমূলক কাজে উৎসাহ জোগায়, তেমনি মন্দ কাজ থেকেও বিরত রাখে। তাই জীবনকে পবিত্র ও মূল্যবান করে তুলতে জিকিরের গুরুত্ব উপলব্ধি করা অপরিহার্য। আর নিজেকে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিয়োজিত রাখা একজন সফল মুমিনের নিদর্শন।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী আইন বিভাগ, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিসর।